সাতক্ষীরার কলারোয়ায় গণহত্যা দিবস উপলক্ষে ৪ দিনব্যাপি কর্মসূচি গ্রহণ।
জুলফিকার আলী,
কলারোয়া(সাতক্ষীরা)প্রতিনিধি:
সাতক্ষীরার কলারোয়ার পালপাড়ায় গণহত্যা দিবস উপলক্ষে ৪দিনব্যাপি কর্মসূচি গ্রহন করা হয়েছে। অভিশপ্ত দিনে ২৮এপ্রিল এই দিনে কলারোয়ার মানুষের স্মৃতিপটে নতুন করে ভেসে ওঠে পাকবাহিনীর ভয়াল, বীভৎস ও নির্মম এক হত্যাযজ্ঞের কথা।
স্বাধীনতা অর্জনের ৫২ বছরেও মুক্তিকামী মানুষ ভুলতে পারেন না কলারোয়ার উত্তর মুরারীকাটি কুমারপাড়ার সেই ভয়াল হত্যাযজ্ঞের কথা। কলারোয়ার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে পালপাড়ার কুমার সম্প্রদায়ের শহিদ ৯ মুক্তিকামী কুম্ভকারের আত্মত্যাগের কথা চিরদিন অম্লান হয়ে থাকবে।
আর বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে এই কুমার পাড়ার স্বজনহারা মানুষেরা এ দিনটি বেদনাবিধূর চিত্তে স্মরণ করেন। উল্লেখ্য-একাত্তরের ২৮এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাক-হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের শিকার হন কলারোয়ার পালপাড়ার ৯জন মুক্তিকামী কুম্ভকার।
প্রকাশ্য দিবালোকে এই নারকীয় হত্যাকান্ড সেদিন অনেক মানুষ প্রত্যক্ষ করেন। যাঁদের অনেকেই ওই বীভৎস স্মৃতি নিয়ে আজও বেঁচে আছেন। ঘটনাস্থল কলারোয়া পৌরসদরে বেত্রবতী নদীর পূর্ব পার্শ্বে অবস্থিত উত্তর মুরারীকাটি কুমারপাড়া। যার আজ ডাক নাম পালপাড়া। বর্বরতার এক নৃশংস-ভয়াল দৃশ্যপট রচিত হয় সেখানে। মানুষ যে মানুষকে এত নিষ্ঠুরভাবে মেরে ফেলতে পারে, তা পালপাড়ার গণহত্যা যারা দেখেননি বা জানেন না, তারা বুঝতে পারবেন না।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ তখন রীতিমত উত্তাল। জীবণ বাজি রেখে বাংলার দামাল ছেলেরা তখন লড়ছে রণাঙ্গণে মুক্তিযুুদ্ধের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত এবং কুমার সম্প্রদায়ের প্রায় সবাই তখন সীমান্ত পেরিয়ে আশ্রয় নিচ্ছিলেন ভারতে। কুমারপাড়াতেও চলছিল ভারতে যাওয়ার তোড়জোড়। সিদ্ধান্ত ছিল দুই এক দিনের
মধ্যেই তারাও এদেশ ছেড়ে পাড়ি জমাবেন ভারতে। কিন্তু কীভাবে যেন এদের এই পরিকল্পনার কথা জেনে যায় হানাদার বাহিনীর দোসররা। তাই তাঁরা সুযোগ পাননি
দেশ ছাড়ার। এলো সেই ভয়াল দিন একাত্তরের ২৮ এপ্রিল, বাংলা-১৬ বৈশাখ, শুক্রবার, ১৩৭৮ বঙ্গাব্দ। দুপুর আড়াইটার দিকে হানাদার পাক সেনা ও তাদের
এদেশীয় দোসররা সশস্ত্র পৈশাচিক হামলা চালায় উত্তর মুরারীকাটি গ্রামের কুমারপাড়ার নিরীহ নিরস্ত্র মানুষের ওপর।
এ সময় পালপাড়ার অনেকে দুপুরের খাওয়া শেষ করেছেন। অনেকেই আবার খাদ্য নিয়ে বসেছেন। ঠিক ওই সময় তাদের ওপর অতর্কিতে হামলা চালিয়ে নির্বিচারে গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে
খুঁচিয়ে হত্যা করা হয় ৯জন মুক্তিকামী কুম্ভকারকে। গুলিতে ও বেয়নেটের আঘাতে জর্জরিত প্রাণহীন দেহগুলো লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। পড়ে থাকে দুপুরের সেই
খাবারগুলো। বৈশাখের তপ্তমাটি সিক্ত হয় দেশপ্রেমীদের তাজা রক্তে।
ওই পৈশাচিক ঘটনার স্মৃতি এ জনপদের মানুষ কখনো ভুলবেন না। ভুলতে পারেন না। পাকবাহিনীর নির্মম-নারকীয় গণহত্যার শিকার হন:-বৈদ্যনাথ পাল (৪৫), নিতাই পাল (৪০), গোপাল পাল (৪২), সতীশ পাল (৪৫), রাম চন্দ্র পাল (৪০), বিমল পাল (৪২), রঞ্জন পাল (৪০), অনিল পাল (৪৫) ও রামপদ পাল (৪২)। শিবু পাল
মারাত্মকভাবে বেয়নেটবিদ্ধ হয়েও জীবিত ছিলেন। আহত ত্রৈলক্ষ পালকে ভর্তি করা হয় ভারতের সাঁড়াপুল হাসপাতালে। তার সাথে স্বজনদের যোগাযোগ করিয়ে দেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও ভাষা সৈনিক প্রয়াত শিক্ষাবিদ শেখ আমানুল্লাহ। অপর আহত শিবু পাল চিকিৎসার জন্য ভর্তি হন ভারতের বনগাঁ সদর
হাসপাতালে।
একই দিনে সকালের দিকে কলারোয়ার মাহমুদপুর গ্রামের আওয়ামীলীগ নেতা আফছার আলী (৪৮) হানাদার বাহিনীর হাতে প্রথম শহিদ হন। আর কুমারপাড়ার শহিদদের স্মরণে গড়ে তোলা হয়েছে স্মৃতিসৌধ। এর পাশেই রয়েছে রাধা-গোবিন্দ
মন্দির। প্রতি বছর ১৬ বৈশাখ শহিদদের সন্তান, স্বজন ও সতীর্থরা বিদেহী আত্মার মঙ্গল কামনা করে এখানে পালন করেন বিভিন্ন মঙ্গলাচার ও নাম সংকীর্তন অনুষ্ঠান। পালপাড়ার গোষ্ঠ চন্দ্র পাল ও হরেন্দ্র নাথ ময়না
জানান, শোকাবহ এ দিবস উপলক্ষে এবার উত্তর মুরারীকাটি পালপাড়ায় সম্মিলিত ভাবে ৪দিনব্যাপি কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে-মঙ্গল প্রদীপ
প্রজ্জ্বলন, ভগবত আলোচনা, মহানামসংকীর্তন, প্রসাদ বিতরণ।
৪দিনব্যাপি এ কর্মসূচি শুরু হবে ২৯ এপ্রিল, শনিবার থেকে। শহিদদের স্মরণে স্মৃতিসৌধে সকলকে আমন্ত্রিত।