অন্যান্য সংবাদ

বাবা বললেন, তার সুন্দর মুখটি দেখতে চাই শিশু আয়াত হত্যায় কাঁদছে চট্টগ্রাম

‘আমার মেয়ের পা এখনও পচেনি। তার মুখ অনেক সুন্দর। আমি সুন্দর মুখটি দেখতে চাই। এই মুখ দিয়ে সে বাবা বাবা বলে ডাকত। কোরআন পড়ত।’ ১৬ দিন নিখোঁজ থাকার পর গতকাল বুধবার উদ্ধার হওয়া ছোট্ট আলীনা ইসলাম আয়াতের খণ্ডিত দুই পা দেখে এভাবেই বিলাপ করছিলেন বাবা সোহেল রানা। চট্টগ্রাম নগরের আকমল আলী ঘাটের স্লুইসগেট এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয় আয়াতের দেহের অংশ। এ সময় সেখানে সৃষ্টি হয় হৃদয়বিদারক দৃশ্যের। কান্নায় ভেঙে পড়েন তার বাবা, দাদাসহ স্বজনরা। তাঁদের আহাজারিতে উপস্থিত অনেকেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি।
মেয়েকে জান্নাতবাসী দাবি করে পিবিআইর উদ্দেশে সোহেল রানা বলেন, তারা এত দিন ধরে উদ্ধারকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের অনুরোধ করব, আরও কয়েক দিন উদ্ধারকাজ চালাক, যাতে মেয়ের মাথাসহ শেষ অংশটুকু পাওয়া যায়। আয়াতের বৃদ্ধ দাদাও জরাজীর্ণ শরীর নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন ঘটনাস্থলে। তিনি বিলাপের সুরে প্রশ্ন করেন, কেন তার নাতনিকে এমন নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো? কী ছিল তার অপরাধ?

আসামি আবীর আলীর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গতকাল ৫ বছরের আয়াতের পলিথিন মোড়ানো দুই পা উদ্ধার করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। পরিবারের সদস্যরা শনাক্ত করলেও নিশ্চিত হতে ডিএনএ নমুনা মিলিয়ে দেখবে পুলিশ। শিশু আয়াতকে খুনের পর লাশ ছয় টুকরো করে সাগরে ভাসিয়ে দেওয়ার ঘটনায় আবীর ছাড়াও তার বাবা-মা ও ছোট বোনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আদালত এ তিনজনের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। তবে বোন অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
এ প্রসঙ্গে পিবিআই মেট্রোর পরিদর্শক ইলিয়াস খান ভোরের কিরণ কে বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে আয়াতকে হত্যার পর ছয় টুকরো করার তথ্য দিয়েছিল আবীর। সে মাথা থেকে শরীরের একটি অংশ ইপিজেড বেড়িবাঁধ এলাকায় সাগরে এবং পাসহ অন্য অংশ আকমল আলী ঘাটের স্লুইসগেটের মুখে ফেলে দেয়। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে স্লুইসগেট এলাকা থেকে পলিথিনে মোড়ানো দুটি পা উদ্ধার করা হয়।

মামলার তদন্ত-সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, মরদেহের খণ্ডিত অংশ যে স্থানে ফেলে দেওয়ার কথা বলেছিল আবীর, এর পাশ থেকেই পা দুটি উদ্ধার করা হয়েছে। আসামির স্বীকারোক্তির সঙ্গে মিললেও ডিএনএর নমুনা নেওয়ার জন্য এগুলো মর্গে পাঠানো হয়েছে। পাগুলোর ডিএনএর নমুনার সঙ্গে আয়াতের বাবা সোহেল রানা ও মা সাহিদা আক্তার তামান্নার ডিএনএর নমুনা মিলিয়ে দেখা হবে

আয়াতের দাদা মনজুর হোসেন ভোরের কিরণ কে বলেন, কোমরের নিচ থেকে পা পর্যন্ত পাওয়া গেছে। এগুলো তাঁর নাতনির। তিনি বলেন, ‘কেন নৃশংসভাবে হত্যা করল, জানি না। তার সঙ্গে তো আমাদের কোনো বিরোধ নেই। আমরা তার ফাঁসি চাই।’
গত ১৫ নভেম্বর নগরের ইপিজেড থানার বন্দরটিলা নয়ারহাট এলাকায় বাসার সামনে থেকে নিখোঁজ হয় আলীনা ইসলাম আয়াত। এ ঘটনায় ২৪ নভেম্বর রাতে তাদের ভাড়াটিয়া আজহারুল ইসলামের ১৯ বছর বয়সী ছেলে আবীর আলীকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। জিজ্ঞাসাবাদে সে আয়াতকে শ্বাসরোধে হত্যার পর ছয় টুকরো করে সাগরে ভাসিয়ে দেওয়ার কথা স্বীকার করে। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরদিন লাশ টুকরোর কাজে ব্যবহূত দা ও আয়াতের পায়ের জুতা উদ্ধার করা হয়।

পিবিআইর ভাষ্যমতে, মুক্তিপণ আদায়ের জন্য আয়াতকে অপহরণের পরিকল্পনা করে আবীর। ১৫ নভেম্বর বিকেলে বাসার সামনে থেকে আয়াতকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে আবীর ঢুকে যায় তার বাবার বাসায়। সেখানে ১৫ মিনিটের মধ্যে শ্বাসরোধ করে সে আয়াতকে খুন করে। এর পর লাশ ব্যাগে ভরে নিয়ে যায় নগরের আকমল আলী সড়কের পকেট গেট বাজার এলাকায় তার মা আলো বেগমের বাসায়। মা-বাবার মধ্যে বিচ্ছেদের পর আবীর মায়ের বাসায় থাকত। বাবার বাসায়ও তার যাতায়াত ছিল। আবীর মায়ের বাসায় নিয়ে লাশ বাথরুমের সানশেডের ওপর লুকিয়ে রাখে। রাতেই ওই লাশ বাথরুমে নিয়ে কেটে ছয় টুকরো করে ছয়টি ব্যাগে ভরে রাখে।

পরদিন ১৬ নভেম্বর সকালে লাশের তিনটি টুকরো আউটার রিং রোড এলাকায় সাগরে ভাসিয়ে দেয়। ওই দিন রাতে বাকি তিন টুকরো আকমল আলী রোডের স্লুইসগেট এলাকায় ফেলে দেয়। কিন্তু মুক্তিপণ আদায়ের জন্য সংগ্রহ করা সিম ব্লক থাকায় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারেনি আবীর।
১৫ নভেম্বর বিকেলে আরবি পড়তে স্থানীয় মসজিদের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হলে আয়াতকে বাসার গলিতেই কোলে নেয় আবীর। অন্য শিশুরা এটা দেখেছিল। আশপাশের বিভিন্ন সিসি ক্যামেরার ভিডিও বিশ্নেষণ এবং স্থানীয় শিশুদের সঙ্গে কথা বলে আবীরকে আটক করা হয়। হত্যার ঘটনায় আয়াতের বাবা সোহেল রানা ইপিজেড থানায় মামলা করেন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button