অন্যান্য সংবাদ

দেশ গড়তে ভ্যানগাড়িতে বই নিয়ে ছুটছেন মুক্তিযোদ্ধা এনছান আলী

ভ্যানগাড়িতে মুক্তিযোদ্ধা এনছান আলী।

সংবাদদাতা, বাকেরগঞ্জ, বরিশাল

আবার ফিরে এলো বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। অহংকার আর গৌরবের মাস এটি। নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পরাজিত হয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। আমরা পেয়েছি লাল সবুজের পতাকা শোভিত স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছিল মুক্তিযোদ্ধারা। জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও ভ্যানগাড়িতে ছুটছেন বই নিয়ে দেশ গড়ার লক্ষ্যে বাকেরগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা এনছান আলী।

বীর মুক্তিযোদ্ধারা কখনও তাদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করেননি। এমনই একজন নিঃস্বার্থ মুক্তিযোদ্ধা এনছান আলী খান। অকৃত্রিম বিবেকবোধ দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসার টানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ তার শক্তি ও সাহস যোগায় মুক্তিযুদ্ধে।

মুক্তিযুদ্ধা এনছান আলী খান ১৯৩৬ সনে বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার রঙ্গশ্রী ইউনিয়নের বিহারি পুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আব্দুল গনি খান ছিলেন একজন কৃষক। ছয় ভাই ও দুই বোনের মধ্যে ইনছান আলী খান ৪র্থ সন্তান। বাবার অভাবী সংসারে অতি কষ্ট করে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কাফিলা হাই স্কুলে লেখাপড়া করেন তিনি।

তৎকালীন তিনি পুলিশের চাকরি করতেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ট্যাংক-কামান আর বন্দুক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা। ১৯৭১ এর রণাঙ্গনে মুক্তিকামী সৈনিক ২ নম্বর সেক্টরে ক্যাপ্টেন হায়দার আলীর নেতৃত্বে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। সোনারগাঁও, কাচপুর, মুগ্ধাপাড়া,আদমজী জুট মিল সংলগ্ন এলাকায় দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ঢাকা সারদা পুলিশ লাইনে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিয়ে দেশরক্ষায় জীবনকে তুচ্ছ করে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন।

যুদ্ধের মাঠে লড়াই এর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, আহার-নিদ্রা কি জিনিস ভুলেই গেছিলাম। চোখের জলে বলেন, স্বপ্ন একটাই ছিল মাতৃভূমি মানেই মা জীবন দিয়ে হলেও তাকে বাঁচাতে হবে। যুদ্ধ চলাকালীন অসংখ্য বার মৃত্যুর দুয়ারে গিয়েও যুদ্ধ করে বেঁচে রয়েছি। এখনো মনে পড়লে ঘুম আসে না। কাঁচপুর ব্রিজের উপর পাকিস্তানি মিলিটারির সঙ্গে অনেকক্ষণ গোলাগুলি হয় চারপাশ দিয়ে আমাকে ঘিরে রাখে অস্ত্র কাঁধে নিয়ে বাধ্য হয়ে ঝাঁপ দেই নদীতে।

অসংখ্য মৃতদেহ ভাসতে থাকে নদীতে ,একটি মৃতদেহ জড়িয়ে ধরে নদীর কিনারায় গিয়ে উঠি। যুদ্ধশেষে স্বাধীনতা লাভের পরে অর্ধাহারে-অনাহারে কেটেছে কয়েক যুগ। বর্তমানে বই বিক্রেতার পেশাকে পাথেয় করে এক সন্তানের পিতা সংসার চালনা করছেন। আজ জীবনের এই ক্রান্তিলগ্নে ৮৬ বছর বয়সেও স্বপ্ন দেখে আগামী দিনগুলোর।

মুক্তিযোদ্ধা ইনছান আলী খান বলেন, বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনমান উন্নয়নে নানাবিধ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। তাদের জন্য বাসস্থান,চিকিৎসা সেবা, কোটাভিত্তিক সরকারি চাকরিতে নিয়োগ এবং তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী,ভাতা বীর নিবাসসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আশা করি এ সুযোগ-সুবিধা পর্যায়ক্রমে বাড়ানো হবে।

তিনি আরও বলেন, আমি ৩০০ টাকা থেকে শুরু করে এখন ২০ হাজার টাকা সম্মানী ভাতা পাচ্ছি। সম্মানী ভাতা দিয়ে আমার সংসার চলে যায়। গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে ভ্যান গাড়িতে বই বিক্রি করি মানুষের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও ইসলামী শিক্ষার দিনের আলো ছড়িয়ে দেয়ার জন্য।ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে পারে সেজন্য আমি বাকেরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের পল্লীর পাড়ায় পাড়ায় ঘুড়ে ঘুড়ে ভ্যান গাড়িতে করে বর্তমান প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে বিনা লাভে স্বাধীনতার ইতিহাস,বঙ্গবন্ধুর জীবনীসহ বিভিন্ন রকমের বই বিক্রি করতেছি। এতে করে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে পারবে।

জীবনের শেষ মুহূর্তে নানান রকম রোগে আক্রান্ত হয়ে শরীরের শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। ভ্যান গাড়ি যেন এখন চলছে না। দুই পায়ে দেখা দিয়েছে ব্যথা। পাড়া মহল্লায় ভ্যান গাড়ি নিয়ে বই বিক্রি করতে কষ্ট হচ্ছে। আমি বাড়ি ঘর চাই না। আমার জীবনের শেষ প্রান্তে একটা দাবি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে পারে সরকার আমাকে একটি দোকান ঘর দিলে ভ্যান গাড়িতে নয় দোকানে বসে বই বিক্রি করতাম। আমি একটি দোকান ঘরের জন্য জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত দরখাস্ত দিয়েছি। একটি দোকান ঘর পেলে কষ্ট থাকতো না। উপজেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button