কোথায় হারাল সেই পয়লা বৈশাখ
বাংলাদেশে প্রতি বছর মহা ধুমধামে উৎসবমুখর পরিবেশে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপিত হয়। বৈশাখী উৎসবে থাকে প্রাণের ছোঁয়া, থাকে উচ্ছ্বাসের বাঁধভাঙা জোয়ার। অতীতের ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতা ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদ্যাপিত হয় বাঙালির নববর্ষ। শিশু-যুবা-বৃদ্ধসহ সব বয়সের সব শ্রেণি মানুষ এ দিনটি উদ্যাপন করে। বাংলা নববর্ষ বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রধান উপাদান। এ উৎসবের প্রধান অনুষঙ্গ বৈশাখী মেলা।
আরবি হিজরি সনকে ভিত্তি করেই বাংলা সনের উৎপত্তি। মুঘল সম্রাট আকবরের (১৫৫৬-১৬০৫) আমলে বাংলার কৃষকদের সুবিধার্থে হিজরি সনকে ভিত্তি ধরে বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। হিজরি বছর সৌর বছর থেকে ১১ দিন ছোট হওয়ায় এ দেশের ঋতু পরিবর্তনের সাথে হিজরি বছরের মিল হয় না। এতে কৃষকদের ফসলি সন গণনায় সমস্যা হয়। কৃষকের কাছ থেকে জমিদারের খাজনা আদায়েও সমস্যা দেখা দেয়। কৃষকের সমস্যা দূর করতে এবং জমির খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে মূলত বাংলা সনের প্রবর্তন করা হয়। বাংলা নববর্ষ বাঙালির হলেও সেটির আনন্দ ও আমেজটা কৃষকের ঘরেই বেশি দেখা যেইংরেজ শাসনামল অবসানের পর কালক্রমে নববর্ষ উদ্যাপন উৎসবে পরিণত হয়। বিশেষ করে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও পরবর্তীকালের নানা ঘটনা বাংলা নববর্ষ উদ্যাপনকে প্রাণবন্ত ও বিস্তৃত করেছে। যদিও বর্তমান সময়ের নববর্ষ উদযাপনে পান্তাভাত ও ইলিশ ভাজাসহ মুখরোচক অনেক খাবারের সমারোহ ঘটলেও এতে প্রাণের স্পর্শ পাওয়া যায় না। ধনী ও বিলাসী মানুষের বিনোদনের ব্যবস্থা হলেও দরিদ্র ও অসহায় মানুষের অন্তরে প্রকৃত সুখ আসে না। আধুনিক যুগের শহরের মানুষের প্রাণহীন জমকালো বর্ষবরণের ডামাডোলে হারিয়ে যাচ্ছে নিবিড় পল্লির প্রীতিপূর্ণ ছোট ছোট উৎসবগুলো। উঠতি ধনীদের প্রভাব ও বড়োলোকি মনোভাবের কাছে বাঙালি কৃষকের সেই উৎসবেরও রূপ বদলে গেছে।একটা সময় গ্রামগঞ্জে বৈশাখী মেলা বসত। সেসব মেলা এখন কমে গিয়েছে। কৃষিজ পণ্য, কুঠির শিল্প দ্রব্য, মৃৎ ও হস্তশিল্প দ্রব্য, আসবাবপত্র ইত্যাদি ক্রয়-বিক্রয়ের ধুম পড়ত সেসব মেলায়। মেলার সময় নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা, কুস্তির আসর, এমনকি মেলায় ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই, বলী খেলা ইত্যাদি বিনোদন ও ক্রীড়া অনুষ্ঠান বসতো। তখন মেলা ছিল বাঙালির প্রাণের উৎসব। মেলা উপলক্ষে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়ানো ও আপ্যায়নের ব্যবস্থা হতো। আর বিবাহিতা মেয়েরা নাইওর আসত বাপের বাড়ি। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাই বৈশাখী মেলায় আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠত। শিশুদের খেলাধুলার জন্য ঘুড়ি, মাটির তৈরি হাতি-ঘোড়া ইত্যাদি বেচা-কেনা হতো। মেয়েদের হাতের চুড়ি, কানের দুল গলার হার ইত্যাদিও। এ ছাড়া জুড়ি-বুন্দি, জিলাপি, রসগোল্লাসহ নানা ধরনের মিষ্টি ও মুখরোচক খাবারের সমারোহ ছিল বেশ চমৎকার।
একটা সময় কৃষকেরা চৈত্র মাসের শেষ দিনে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করে দিত। এরপর দিন অর্থাৎ পয়লা বৈশাখ ভূমির মালিকেরা তাদের প্রজা সাধারণের জন্য মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়নের ব্যবস্থা রাখতেন। পরবর্তীতে তা ব্যবসায়িক পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে। দোকানিরা সারা বছরের বাকির খাতা সমাপ্ত করার জন্য পয়লা বৈশাখের দিনে নতুন সাজে বসেন দোকানে। গ্রাহকদের মিষ্টিমুখ করিয়ে শুরু করেন নতুন বছরের ব্যবসার সূচনা। একটা সময় হালখাতার এ রেওয়াজ খুব দেখা গেলেও সময়ের পরিক্রমায় সেটি কমে এসেছে